কারও বাড়িতে বসে এরকম প্রশ্ন করলে তিনি হয় লাঠিপেটা করবেন। নয় তো মা-মাসি উদ্ধার করে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেবেন। কিন্তু তিনি আমার কথা শুনে শুধুই মুচকি হাসলেন। কোনও তাপ উত্তাপ নেই। রাগ অভিমান নেই।
শান্ত ভাবে বললেন, ‘তাপসী মালিকের খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর এ রকম অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছে। জেলে ঢোকার পর প্রথম দিকে কয়েদিরাও আমাকে অনেক কটু কথা বলত। এখন আর গায়ে মাখি না।'
অভিমানের সুর সুহৃদের গলায়।
কিছুক্ষণ চুপ। আবার বলা শুরু করলেন।
'আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছিল আদালতে তার কোনও প্রমাণ দিতে পারেনি সিবিআই। নিম্ন আদালত দোষী সাব্যস্ত করলেও হাইকোর্ট আমাকে জামিন দিয়েছে। আমার জামিন খারিজ করার জন্য সিবিআই সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সেটা খারিজ করে দিয়েছে। আপিল মামলায় হাইকোর্টের শুনানিতে সিবিআইয়ের আইনজীবী দিনের পর দিন গরহাজির থাকছেন। জানি না এই মামলা কবে শেষ হবে।’
তাহলে বলছেন আপনার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মিথ্যা?
উল্টো দিক থেকে জবাব এল, ‘আমি ষড়যন্ত্রের শিকার। টাটাদের প্রতিযোগীরা যে ন্যানো গাড়ির উৎপাদন ঠেকাতে চেয়েছিল। আমার কথায় বেশির ভাগ মানুষ কারখানার জন্য জমি দিতে এগিয়ে এসেছিলেন। সে জন্যই আমাকে বলির পাঁঠা করা হয়েছে।’
এক নিশ্বাসে বলে গেলেন কমরেড সুহৃদ দত্ত।
তাপসী মালিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে এক সময় তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য-রাজনীতি। তাতে নাম জড়িয়ে যায় সুহৃদ দত্তের। তখন তিনি ছিলেন সিপিএমের সিঙ্গুর জোনাল সম্পাদক। ২০০৭ সালের জুন মাসে সিবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তার হন সুহৃদ দত্ত এবং দেবু মালিক। প্রায় দু’বছর জেলে ছিলেন। তারপর ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারিতে জামিনে ছাড়া পান।
জেল থেকে ছাড়া পেলেও আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। অসুস্থতা তাঁকে গ্রাস করেছে। গোটা শরীরে বিষাক্ত ঘা। অনেক ডাক্তার দেখিয়েও রোগ ভালো করা যাচ্ছে না। লুঙ্গিটা খানিক উঠিয়ে পায়ের ঘা দেখিয়ে বললেন, ‘সিবিআই যখন আমার নারকো টেস্ট করায় তখন একটা ইনজেকশন দিয়েছিল। তার ঠিক পরের দিনই পায়ে র্যাশ বেরোয়। সেটা দেখতে অনেকটা ফোস্কার মতো। তা থেকেই সারা শরীরে ঘা ছড়িয়ে পড়ে। স্মৃতিশক্তিও অনেকটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখন অনেক কিছুই মনে রাখতে পারি না।’
সিঙ্গুরে টাটাদের ন্যানো কারখানা যেখানে তৈরি হয়েছিল, সেখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে জলাপাড়া এলাকা। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নেমে পিচের রাস্তা ধরে যাওয়ার পর সরু গলির মধ্যে সুহৃদ দত্তদের পৈতৃক বাড়ি। সুহৃদ দত্তের বাড়ি যাব বলতেই এক সহৃদয় ব্যক্তি দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।
পাঁচিল ঘেরা সুন্দর ছিমছাম দোতলা বাড়ি। গেরুয়া রং। পাঁচিল দিয়ে ঢুকেই চোখে পড়ল গেটের সামনে ঝুলছে ফ্রেমে বাঁধানো শ্রীকৃষ্ণের ছবি। বাড়ির গেরুয়া রং আর শ্রীকৃষ্ণের ছবি দেখে ঝটকা লাগলো।
কলকাতা থেকে সাংবাদিক দেখা করতে এসেছে শুনে গুটি-গুটি দোতলা থেকে নীচে নামলেন সত্তরোর্ধ্ব মানুষটি। তার পর নিয়ে গেলেন পাশের ঘরে। ঘরের দেওয়ালে ঝুলছে মার্কস, এঙ্গেলস, রবীন্দ্রনাথ, লেনিন ও স্ট্যালিনের বাঁধানো ছবি। ঘরে ছোট্ট তক্তপোশ। কয়েকটা কাঠের চেয়ার আর একটা টেবিল।
কথা বলার ফাঁকে তাঁর কাছ থেকেই জানতে পারলাম, বাড়িতে আপনজন বলতে কেউ নেই। এক সময় চাকরি করতেন। পরে চাকরি ছেড়ে হয়ে যান সিপিএমের সর্বক্ষণের পার্টি কর্মী। বললেন, 'দল করতে গিয়ে বিয়ে করার কথা মাথায় আসেনি। বলতে পারেন, আমি ঝাড়া হাত পা। ভাই বোনেদের সংসারে থাকি।'
তাপসী মালিকের নাম উচ্চারণ করতেই সবিনয়ে বললেন, ‘আমাকে একটু সময় দিতে পারবেন? তা হলে আপনাকে কিছু জিনিস দেখাতে পারি।’ বলেই উঠে গেলেন দোতলায়।
কিছুক্ষণ পর একটা মোটা কাগজের বান্ডিল নিয়ে হাজির হলেন। তার মধ্যে কোনওটা চার্জশিটের কপি। কোনওটা আবার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। কয়েকটা জেরক্স কপি হাতে ধরিয়ে বললেন, আগে এটা ভাল করে পড়ে দেখুন।
সেই কাগজে চোখ বোলাতে গিয়ে এক জায়গায় দৃষ্টি আটকে গেল। তাপসীর মৃত্যুরহস্য নিয়ে সিবিআই ক্রাইম ব্রাঞ্চের সুপারিন্টেডেন্টকে একটি রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন এসএসকেএম হাসপাতালের ফরেনসিক এবং স্টেট মেডিসিনের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক এ কে গুপ্তা। সেই রিপোর্টের এক জায়গায় তিনি বলছেন: The appearance of the external os and the cavity of the uterus as seen by me on reviewing the video cassette appears to be in conformity with a case of abortion in recent past.
In absence of the report of verginal swab and smear i.e whether spermatozoa or seminal fluid or DNA of a male sbject are detected in them, it is not possible to opine definitely whether she was sexually violated in recent past i.e prior to death. However further report may be submitted after receiving the above mentioned report.
Considering the findings in the post-mortem report, the findings observed by me on reviewing of video cassette on post-mortem examination of Tapasi Malik and visit to the place of detection of dead body of Tapasi Malik. I am finally opine that death of Tapas Malik was due to the effects of ante-mortem burn injuries which were in probability homicidal in nature as she was put to flame after incapacitating her by causing ante-mortem injuries especially heamatoma (extravasation) over her head.
তার বাংলা তর্জমা করলে এটাই মানে দাঁড়ায় যে, মৃত্যুর কয়েক দিন আগেই তার অ্যাবরশন করানো হয়েছিল। তার যৌনাঙ্গে শুক্রাণু বা সেমিনাল তরল বা পুরুষের ডিএনএ পাওয়া যায়নি।
কাগজের পাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখতে পেলাম, বেশ কয়েকটি লাইনের উপর সবুজ মার্কার দিয়ে দাগ করা রয়েছে। সেটা দেখিয়ে সুহৃদ দত্ত বললেন, 'কি কিছু বুঝলেন? আপনারা তো এসব লিখবেন না।'
কিছুটা অনুযোগের সুরেই বললেন, 'তখন তো লোকে কত কথাই বলেছিল। আমার দলের লোকেরাও অনেকে সন্দেহ করেছিল। একটা মিথ্যা অভিযোগে আমাকে জেল খাটতে হয়েছে। তাতে আমার কোনও দুঃখ নেই। তাতেও যদি ওরা কারখানাটা করতে দিত, আমি সব থেকে খুশি হতাম। সেটাই তো করা গেল না।'
'বিনা দোষে' জেল খাটার জন্য বিরোধীদের ষড়যন্ত্রকে দায়ী করলেও সিঙ্গুর থেকে ন্যানো বিদায়ের জন্য নিজের দলকেই কাঠগড়ায় তুললেন। বললেন, ‘আমরা মানুষকে বোঝাতে পারিনি, এটা আমাদের দলের ব্যর্থতা। আমি নিজেও টাটার কর্তাদের সঙ্গে দেখা করে বলেছিলাম, সিঙ্গুরে যখন আপত্তি উঠছে আপনারা অন্য জায়গায় কারখানাটা করছেন না কেন? কিন্তু তাঁরা এত সুন্দর জায়গা হাতছাড়া করতে চাননি। বিরোধীদের চক্রান্তের মোকাবিলা করতেও আমাদের সরকার ব্যর্থ হয়েছে। তার ফল ভুগতে হচ্ছে সিঙ্গুরের মানুষকে। কারখানাও হল না। চাষিরা জমি ফেরত পেলেও তাতে চাষ করাও যাচ্ছে না! যারা একসময় টাটাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল তারাই এখন আপশোস করছে।’
Please see other posts in this blog page by clicking "Home" or from "My Favorite Posts" / "Popular Posts" / "Archives" sections, and if any remarks please feel free to post.
Thanks & Jai Hind!! Saroop Chattopadhyay.