শিক্ষক মহাশয় ও সরকারি কর্মীদের প্রাপ্য বেতন, ডিএ, বিধায়কদের নানান দাবি প্রভৃতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে আজ মুখ্যমন্ত্রী গলা উঁচিয়ে আঙুল তুলে বললেন," সব সময় এটা দাও, ওটা দাও বললে হবে না। সরকারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, এটা বুঝতে হবে। টাকা আসবে কোত্থেকে?"
কথা গুলো শোনার পর থেকেই কিছু লেখার ইচ্ছা হচ্ছে? নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। মুখ্যমন্ত্রীর সেই অমোঘ প্রশ্ন, আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, টাকা আসবে কোথা থেকে? প্রশ্ন গুলো বারবার আমাদের মাথায় এসেছে। কখন কখন মনে হয়েছে সে কথাই বলবো।আগে বলি, আমি কথাগুলো বলছি কেন? বলছি কারন আমাদের প্রাপ্য দেবার প্রসঙ্গে,আর নাগরিক পরিষেবার ক্ষেত্রে তিনি কথাগুলো বলেছেন।তাই আমাকে ভাবিয়েছে বেশি। শুধু কাল নয়, আগেও বলেছেন মাইনে দিতে সব টাকা চলে গেলে, উন্নয়ন হবে কিসে?
প্রশ্ন এখানেই, সরকারে বসার সময়ই তো জানা ছিল সরকারি কর্মীদের বেতন দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। কেন্দ্রের সমান ডিএ বা অন্য রাজ্যের সমান স্কেল পাবার অধিকারও যে ন্যায্য দাবী তাও তো জানতেন। আজ ডিএর দাবিকে ঘেউ ঘেউ মনে হলেও,এক কালে সেই ঘেউ ঘেউ সরি দাবিতে আপনি সহমত ছিলেন। বকেয়া ডিএ মিটিয়ে দেবার আশ্বাসও তো দিতেন। তখন সরকারের আর্থিক অবস্থা নিশ্চয়ই ভালোই ছিল। তাই বকেয়া মেটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাহলে আজ সরকারের আর্থিক দুরবস্থার দায় কার?
আপনি এককালে বলতেন আগের সরকার ঋণে ডুবিয়ে দিয়ে গেছে রাজ্যটাকে। তখন দেনা ছিল কতো ১ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকার মতো। সবটাই কিন্তু বাম সরকারের করা নয়। বাম সরকার আসার সময়ই রাজ্যের মাথায় ছিল প্রায়৭০হাজার কোটির ঋণ। তার পর ৩৪ বছরে ঋণ বেড়েছিল অনেকটাই। তারপর এলো এই সরকার। নতুন অর্থমন্ত্রী, নতুন দিশার আশায় অপেক্ষা করলাম আমরা। পেলাম কী? ১লক্ষ ৯০ হাজার কোটির ঋণ ৪ লক্ষ কোটি ছাড়িয়েছে আজ। তখন রাজ্য ঋণে ডুবে থাকলে এখন কোন অতলে? জানতো না সরকার?
আপনি আজ বলছেন রাজ্যের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। টাকা আসবে কোথা থেকে? আমরা এই কথা গুলোই ভেবেছিলাম সেই দিন, যখন রাস্তার হ্যালোজেনের নিচে নিচে বসলো ত্রিফলা। আমার মতে নিস্ফলা। কোন প্রয়োজন ছিলোনা। গ্রামের অন্ধকার রাস্তায় লাগানো হলে কাজে লাগতো। এরা সৌন্দর্য হয়তো বাড়ালো, কিন্তু খরচ বাড়ালো বহুগুন। ইলেকট্রিকের অপচয়, বলবে কে? তারপর তার পোস্ট গুলোও সাজলো রঙিন আলোয়। আর আলোর ঝলকানির নিচে বাড়ল ঋণের বোঝা।মুখের সৌন্দর্য বাড়াতে গিয়ে সারা শরীরটাই শুকিয়ে গেলো। মনে হয়নি সেদিন টাকা আসে কোথা থেকে?
টাকা খরচ, উন্নয়নে ব্যয় এক জিনিস, আর অপচয় অন্য কথা। রাজ্যে শুরু হোল টাকা অপচয়। রাস্তা ঘাট ব্রিজ ল্যাম্পপোস্ট সব নিল সাদার হিড়িক লাগলো। সদ্য রঙ করা অফিস, স্কুল আবার নতুন করে রঙ করাতে বাধ্য করা হল।আমাদের মনে হোল টাকা আসে কোথা থেকে? শুরু হল উৎসবের ঝড়, মাটি উৎসব,সবলা মেলা, হস্তশিল্প মেলা,সিনেমা উৎসব কোটি কোটি টাকা খরচ। মনে হয়নি আর্থিক অবস্থা খারাপ? প্যাটেলের মূর্তির খরচ নিয়ে অনেক কথা উঠেছে, কিন্তু পাড়ায় পাড়ায়, মোড়ে মোড়ে, পুজো থেকে মেলা,রথ থেকে ঈদ, সিনেমা থেকে যাত্রা,খবরের কাগজ থেকে টিভি সর্বত্র বিশাল বিশাল অগুনতি মুখের ছবি।কার খরচে? কার টাকায়?
চলল দানছত্র। ইমামভাতা, বিষমদ, দুর্গাপুজো, মেয়ের বিয়ে, ক্লাবের দুই লক্ষের হুল্লোড় সব জায়গায় হরির লুট।স্কুলে স্কুলে সাইকেল বিলি, যাদের প্রয়োজন নেই তাদেরও জোর করে দেওয়া হোল ব্যাগ,ছাতা,জুতো,খাতা,সাইকেল সবকিছু।অনেক ক্ষেত্রেই পড়ে পড়ে নষ্ট হলো দান সামগ্রী। বহু স্কুলে হলো জিম।স্কুলে তো আর অফ পিরিওড থাকে না। তাহলে জিম করবে কখন? সপ্তাহে একটা দুটো শরীর শিক্ষার ক্লাসে তো আর জিম হয় না। নিয়মিত অনুশীলন করতে হয়।তাই অনেক ক্ষেত্রেই পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে ২ লক্ষ টাকার সামগ্রী। টাকার অপচয়। আসলে অন্যের টাকা, জনগনের করের টাকা বিলোতে ভালো লাগে, মহান হওয়া যায় কতো সহজে।
তাই কাউকে ধামসা মাদল,কাউকে উত্তরীয়, কাউকে বিভুষণ পুরস্কার দেওয়া হতে লাগলো। সস্তা জনপ্রিয়তা।
উন্নয়ন ভেবে উদ্বাহু নৃত্য সহযোগে প্রচার শুরু হোল। কেউ ভাবলো না, টাকা আসে কোথা থেকে? আজ হুঁশ ফিরেছে।
এখানেই শেষ নয়, অফার আরো আছে।যুব বিশ্বকাপ হলো, স্কুলে স্কুলে পাঁচটা করে ফুটবল দেবার এক বিরাট মোচ্ছব হলো।কন্যাশ্রী বিদেশে প্রাইজ পেলো,শুরু এক মাস ব্যাপী উৎসব। একতাই সম্প্রীতি নামে কদিন চললো হুল্লোড়। লাভের গুড় পিপড়ে খেয়ে গেলো।
চিট ফান্ডের চ্যানেল কিনলো সরকার।সিবিআই আটকানোর জন্য মামলায় গেলো কয়েক কোটি।সিঙ্গুরের শিল্প ভেঙে পতিত জমি বানাতে খরচ হলো কয়েক শো কোটি। শিল্প আনতে কবি সাহিত্যিক সিনেমা স্টার পরিচালক পরিবেষ্টিত হয়ে চললেন বিদেশ, কাজের কাজ লবডঙ্কা। নাইট রাইডার্স কাপ জিতলো,সরকারি টাকার শ্রাদ্ধ করে বিশাল হুল্লোড়। জেলায় জেলায় প্রশাসনিক বৈঠকের নামে যে কতো কোটি গেলো কে রাখে তার হিসাব? এরপরেও আছে।
বিধায়ক মন্ত্রীদের বেতন ৮০০০ থেকে বেড়ে লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে গেলো। কেউ ভাবেনি সরকারের আর্থিক অবস্থা খারাপ।
সরকার হয়ে গেল করে খাওয়ার জায়গা। মন্ত্রীদের মতো সুযোগ সুবিধা দিয়ে বিভিন্ন উপদেষ্টার পদ তৈরি হলো।সুবিধা পেলো পেটোয়া কিছু লোক।বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন কমিটির মাথায় বসলেন মোটা অর্থের বিনিময়ে। বিভিন্ন কমিশন তৈরি হলো। খরচের কোনো হিসাব নেই। কোনো কমিশনই কাজের কাজ কিছু করতে পারলো না। টাকার শ্রাদ্ধ হলো।সেফ ড্রাইভের পোস্টার, গান, অনুষ্ঠান, পদযাত্রায় মেতে উঠলো রাজ্য। কোটি কোটি খরচের পর আ্যক্সিডেন্ট কতোটা কমলো, তার খবর রাখে কে?
এদিকে জন মোহিনী হবার লোভে জলকর, তীর্থ কর তুলে দিলো সরকার। সংকুচিত হলো আয়ের রাস্তা। শিল্প নেই, কাজ নেই তাই বিভিন্ন ভাতা দিয়ে ব্যর্থতা ঢাকলো সরকার। জলের মতো বেরিয়ে গেলো জনগণের অর্থ। একটা ক্লাব চালাতে গেলেও নির্দিষ্ট বাজেট পরিকল্পনা থাকে, এখানে সেসবের ধার ধরলো না কেউ। ফল, রাজ্য ডুবলো ঋণের অতলে।
মোদ্দা কথা রাজ্যের অর্থনীতি আজ গভীর সংকটে। এ থেকে মুক্তি কিভাবে আসবে কেউ জানে না। জি এস টি থেকে রাজ্যের আয় অনেক বাড়লেও সরকারের পরিকল্পনা হীন ব্যয়ের জন্য রাজ্যের এই অবস্থা। রাজ্যের অর্থনীতির অবস্থা, সরকারি কর্মীদের দাবির যৌক্তিকতা সব দিক বিবেচনা করেই স্যাট তার রায় দিয়েছে। সরকার মানবে কিনা সেটা সরকারের হাতে।
কিন্তু কর্মচারীদের মাইনে দিতে গিয়ে সরকারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে, দেনার দায়ে ডুবতে হচ্ছে, উন্নয়ন বন্ধ করতে হচ্ছে এমন অসত্য প্রচার করে সর্বস্তরের সরকারি কর্মচারী, সর্বস্তরের শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মী, এবং শিক্ষার সাথে যুক্ত কর্মীদেরদের জনসমক্ষে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো থেকে বিরত থাকায় শ্রেয় !!
মনে রাখতে হবে, তাদের পরিবার পরিজন ধরলে কয়েক কোটি ভোটের মালিক তারা, ভোট মেশিনারি তারা ??
কাচের ঘরে বসে ঢিল ছুড়লে ঘরটাই ভাঙবে,
লাভ কিছুই হবে না !!
Please see other posts in this blog page by clicking "Home" or from "My Favorite Posts" / "Popular Posts" / "Archives" sections, and if any remarks please feel free to post.
Thanks & Vande Mataram!!
Saroop Chattopadhyay.