আর মাত্র ১৭-১৮ কিলোমিটার। ওইটুকু দূরত্ব জুড়ে নিতে পারলেই একেবারে কারাকোরাম পাসের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করবে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী।
ঐতিহাসিক গিরিপথের ওপারেই ইয়ারকন্দ, কাশগড়, খোটান, শাহিদুল্লার মতো একের পর এক ঐতিহাসিক জনপদ। সুবিশাল শিনচিয়াং প্রদেশকে সুরক্ষিত রাখতে এই জনপদগুলোর প্রত্যেকটা চীনের জন্য সাময়িকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
চওড়া এবং মসৃণ রাস্তা বানিয়ে ভারতীয় বাহিনী হু হু করে পৌঁছে যাবে সেই এলাকার দরজা পর্যন্ত, তা কি চীনের পক্ষে চুপচাপ মেনে নেওয়া সম্ভব! অতএব আবার পুরানো কৌশল। সীমান্ত উত্তপ্ত করে ভারতের কাজ আটকে দেওয়া। কিন্তু সে কৌশলে আর কাজ হচ্ছে না এবার। লাদাখ থেকে অন্তত তেমন খবরই আসছে।
মে মাসের শুরুর দিক থেকেই অশান্তি শুরু হয়েছিলো। প্রথমে লাদাখের প্যাংগং লেকের কাছে, তার পর উত্তর সিকিমের নাথুলা-তে। ১০ মে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম খবর পায় যে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর অন্তত দু’টি এলাকায় মারামারি হাতাহাতি হয়েছে ভারতীয় ও চীনা বাহিনীর মধ্যে।
ধস্তাধস্তি, পাথর ছোঁড়াছুঁড়ি, লাঠালাঠি এইসব। দু'পক্ষেই জখম হওয়ার খবর এসেছিল। তবে চীনা বাহিনীর অন্তত ১০০ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন উত্তর সিকিমের ওই সংঘর্ষের পরে, দাবি ভারতীয় সেনা সূত্রের।
১৯৬৭ সালের পর থেকে ভারত - চীন সীমান্তে গোলাগুলি চলার খবর প্রায় নেই বললেই চলে। সীমান্তে কাঁটাতার লাগাচ্ছিল ভারতীয় বাহিনী সেবার। বাধা দেয় চীন। ভারত বাধা মানেনি। রাইফেল থেকে গুলি চালায় চীনা বাহিনী। ভারতীয় সেনা লাইট মেশিন গান খুলে দেয়। চীন গুলি চালাতে শুরু করে হেভি মেশিন গান দিয়ে। ভারতীয় বাহিনী আর্টিলারি গান থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে।
সে বারও দু’তরফেই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। আর সে বারের পর থেকে সীমান্তে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহার করার বিষয়ে দু'পক্ষেই অনেক বেশি সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। তাই এলএসি বরাবর ভারত ও চীনের বাহিনীর মধ্যে যত সংঘাতের খবর আসে, সবই হাতাহাতি ও পাথর ছোড়াছুড়িতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। এবারও তাতেই ইতি পড়তে পারত উত্তেজনায়। কিন্তু তা হলনা, উত্তেজনা আরও গড়িয়ে গেল।
কারণ চীনের টেনশন এবার অনেক বেশি। পরিস্থিতি ঠিক কেমন এখন লাদাখে??
নয়াদিল্লি এখনও সরকারি ভাবে কিছু জানায়নি। কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এবং সেনা সূত্রে জানা যাচ্ছে, দু’পক্ষই বড় সংখ্যায় বাহিনী পাঠিয়েছে এলএসি-তে।
বড় সংখ্যা বলতে কেমন? দু’তরফেই অন্তত গোটা একটা করে ব্রিগেড,অর্থাৎ প্রায় হাজার তিনেক করে মোতায়েন দু'পাশেই। খবর তেমনই। গলওয়ান উপত্যকাই সবচেয়ে উত্তপ্ত বলে খবর আসছে। সংঘর্ষ শুরু হয়নি। কিন্তু চীনা বাহিনী ওই অঞ্চলে একতরফাভাবে এগিয়েছে এবং শ’খানেক তাঁবু ফেলেছে বলে খবর।
পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ পর্যায়ের সামরিক কর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। তারপর থেকে ভারতও দ্রুত বিপুল বাহিনী পাঠাতে শুরু করেছে গলওয়ান উপত্যকায়।
চীনা বাহিনীর প্রায় মুখোমুখি অবস্থানে তাদের চেয়েও বেশি সংখ্যক সেনা ভারত ইতিমধ্যেই মোতায়েন করে দিয়েছে।
গলওয়ানে আচমকা গজিয়ে উঠা চীনা শিবিরকে ভারত ইতিমধ্যেই তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে বলেও খবর।
তবে উত্তাপ শুধুমাত্র গলওয়ান উপত্যকায় সীমাবদ্ধ নয় বলেও ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ দাবি। প্যাংগং লেকের উত্তরে হট স্প্রিং এলাকায় এবং ডেমচকেও পরিস্থিতি তপ্ত বলে তারাও জানিয়েছেন। সর্বত্রই বাহিনী হাজির হয়েছে দু’তরফ থেকে।
২০১৭ সালে ভুটান চীন সীমান্তের ডোকলামেও কিন্তু পরিস্থিতি এরকম হয়েছিল। ভুটানের সাথেও সীমান্ত নিয়ে বিবাদ রয়েছে চীনের। একতরফাভাবে বিতর্কিত এলাকার মধ্যে দিয়ে রাস্তা তৈরির চেষ্টা করছিল চীন। ভুটানের পক্ষে বাধা দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই বাহিনী পাঠিয়ে দিয়েছিল ভারত।
৭৩ দিন পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল দুই বাহিনী। এবারের সংঘাত ততটাও দীর্ঘায়িত হইনি। তবে এবারে অনেক বড়ো এলাকা জুড়ে উত্তেজনাটা তৈরি হয়েছে। এবার বাহিনীর আকারটাও ডোকলামের তুলনায় অনেক বড়।
কর্নেল সৌমিত্র রায়ের কথায় "আকসাই চীনের সঙ্গে লাদাখের যে সীমানা, সেই সীমানা বরাবর লম্বা রাস্তা বানিয়েছে ভারত। লেহ্ থেকে রাস্তাটা শুরু হয়। কিছুটা দক্ষিণ- পূর্ব গিয়ে দারবুক থেকে বাঁক নেয় এলএসি -র দিকে অর্থাৎ পূর্ব দিকে। তার পর এলএসি র গা ঘেঁষে একটানা ছুটতে থাকে উত্তর দিকে। শিয়ক হয়ে দৌলত বেগ অলদি গিয়ে রাস্তাটা থামে।
ওই রাস্তাটাকেই চীন ভয় পাচ্ছে।
কেন ভয় পাচ্ছে?
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্তার ব্যাখ্যা "সীমান্তে ভারত ভালো রাস্তাঘাট এবং ভালো পরিকাঠামো বানাক, এটা চীন কখনও চায়না। সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারত উন্নয়নের কাজ করুক, এটাও চীন চায়না। কারণ সীমান্তে উন্নত পরিকাঠামো থাকলে ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে ওইসব এলাকায় মসৃণ ভাবে যাতায়াত এবং নজরদারি চালানো সম্ভব।"
নিজের সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী যাতায়াত করুক বা নজরদারি চালাক, তাতে চীনের বলার কী থাকতে পারে?
কর্ণেল রায় বলেছেন "আইনত চীনের কিছুই বলার নেই। কিন্তু আইন ভেঙেই বার বার চীন নাক গলাত। ভারতও তা মেনে নিত। এক সময় চীন আপত্তি করলেই ভারত কাজ থামিয়ে দিত। তাই নাক গলানোকে অভ্যাসে পরিণত করেছিল চীন।
কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে চীনের আপত্তি উড়িয়েই কাজ চালাতে শুরু করে ভারত। পূর্বে অরুণাচল থেকে উওরে লাদাখ পর্যন্ত প্রায় সর্বত্রই বড় বড় রাস্তা, সেতু, বিমানঘাঁটি এবং সামরিক পরিকাঠামো ভারত তৈরি করেছে এই সময়টায়। চীন সেসব আটকে রাখতে পারেনি। বরং ডোকলামে চীন যে রাস্তা তৈরি করেছিল, সেটাকেই আটকে দিয়েছিল ভারত।
পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে, লাদাখের যে কোনও অংশ থেকে তো বটেই, জম্মু কাশ্মীর এবং হিমাচলপ্রদেশ থেকেও যখন তখন হু হু করে পৌছে যাওয়া যাবে আকসাই চীনের সীমানায়। আরও একটু রাস্তা তৈরি হলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে আরও উওরে একেবারে কারাকোরাম পাসের বেস পর্যন্ত। সেটা চীনের পক্ষে খুব অস্বস্তিকর।"
কারাকোরাম পাসের বেস পর্যন্ত ভারত রাস্তা বানিয়ে ফেললে তা চীনের জন্য অস্বস্তিকর কেন? ??
লাদাখে যে সেনা কর্মকর্তারা কাজ করে এসেছেন, তাঁরা বলছেন, কারাকোরাম পাস কৌশলগত বা সামরিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিয়াচেনের উত্তর পূর্ব কোনায় ৫ হাজার ৫৪০ মিটার উচ্চতায় কারাকোরাম পাসের অবস্থান।
প্রগৈতিহাসিক যুগ থেকে ওই গিরিপথ ব্যাবহৃত হয়ে আসছে লাদাখের লেহ্ থেকে তারিম উপত্যকার ইয়ারকন্দের মধ্যে যাতায়াতের জন্য। তারিম উপত্যকা তথা ইয়ারকন্দ এখন চীনের শাসনাধীন। আর লেহ্ তথা লাদাখ ভারতের অংশ।
তাই আগের সেই অবাধ যাতায়াত বহু যুগ ধরেই বন্ধ। কিন্তু সীমান্তে যদি কখনও পরিস্থিতির অবনতি, তা হলে ওই গিরিপথ ব্যাবহার করে হানাদারির চেষ্টা চালাতে পারে দু'পক্ষই।
কারাকোরাম পাসের উওরে অর্থাৎ চীনা এলাকায় রাস্তা ঘাট এবং পরিকাঠামো অনেক দিন আগেই উন্নত করেদিয়েছে চীন। কিন্তু পাসের দক্ষিণে ভারতের পরিকাঠামো এতদিন অনুন্নতই ছিল। ফলে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ভারত চাইলেই কারাকোরামের গিরিপথ দিয়ে হানা দিতে পারবে না, কিন্তু চীন চাইলেই ওই গিরিপথ দিয়ে দক্ষিণে চলে আসতে পারবে- এই ভাবনা স্বস্তি দিত বেজিংকে।
ভারতের নতুন রাস্তা, বেজিঙের সেই স্বস্তি গায়েব করে দিয়েছে বলে ভারতীয় সমর বিশারদদের মত।
দারবুক থেকে দৌলত বেগ অলদি পর্যন্ত ২৫৫ কিলোমিটার রাস্তা তৈরির কাজ শেষ, জানাচ্ছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। ওই রাস্তায় একাধিক সেতু বানাতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় যে সেতু, সেটা তৈরি হয়েছে শিয়ক নদীর উপরে। ২০১৯ এর অক্টোবরে সেই সেতুর উদ্বোধন বেশ ঢাকঢোল পিটিয়েই করেছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ।
দৌলত বেগ অলদিতে ভারত বিমানঘাঁটিও বানিয়ে ফেলেছে আগেই। এবার দৌলত বেগ অলদি থেকে কারাকোরাম পাস পর্যন্ত ১৭-১৮ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করে ফেললেই চীনের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলার তোড়জোড় সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। অনেকরকম ভাবেই এই কাজকে আটকানোর চেষ্টা করেছিল চীন। পারেনি। এবার তাই মরিয়া হয়ে কামড় দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে।
জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) বেদপ্রকাশ মালিক থেকে জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) জে জে সিংহ, প্রত্যেকেই এইরকম মনে করছেন।
কার্গিল যুদ্ধের সময়ে ভারতের সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল মালিক। তিনি বলছেন, ভূপ্রাকৃতিক কারণে এলএসি-র এপাশে অর্থাৎ লাদাখে সেনা পাঠানো ভারতের পক্ষে যতটা সহজ, এলএসি-র ওপাশে অর্থাৎ তিব্বতের দিকে ততটা সহজ নয়।
চীন ওই সব অঞ্চলে সড়ক পরিকাঠামো বাড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিপুল সংখ্যক সেনা নিয়ে এসে এলএসি বরাবর ঘাঁটি গেড়ে থাকা চীনের পক্ষে অপেক্ষাকৃত কঠিন বলে তার মত। ভারতের ক্ষেত্রে সেই অসুবিধা নেই।
ওই সব অঞ্চলে বড় বাহিনী মোতায়েন রাখা ভারতের পক্ষে খুব একটা কঠিন কোনকালেই ছিলনা, সমস্যা ছিল শুধু যাতায়াতের, সেটাও ভারত ক্রমশ মিটিয়ে ফেলেছে, সুতারাং চাপে পড়া চীনের পক্ষে স্বাভাবিক - ব্যাখ্যা জেনারেল মালিকের।
ভূপ্রাকৃতিক দিক থেকে ভারতের জন্য দুর্বল বিন্দু ছিল শুধুমাত্র কারাকোরাম পাস। আর চীনের জন্য সুবিধাজনক বিন্দুও ছিল ওটাই। কারণ কারাকোরাম পাসের ঠিক দক্ষিণে লাদাখের যে অংশ, সে এলাকা এতই জনবিরল এবং মরুভূমি সদৃশ যে, বাহিনী মোতায়েন রাখার পক্ষে ওই এলাকা মোটেও অনুকূল ছিল না।
কিন্তু কারাকোরাম পাসের উওরে তারিম অববাহিকা বা কারকাশ উপত্যকার ভূপ্রকৃতি এবং আবহাওয়া অনেকটাই সহনীয়। ওই অঞ্চলে বাহিনী রাখা বা ওই অঞ্চল দিয়ে তাড়াতাড়ি কারাকোরাম পাস পেরিয়ে আসা অপেক্ষাকৃতভাবে সহজ। নিজেদের জন্য এই সুবিধাজনক পরিস্থিতিটা কোনও ভাবে বদলে যাক, তা চীন চাইনি।
কিন্তু দৌলত বেগ অলদি পর্যন্ত রাস্তা বানিয়ে, যোগাযোগ ও অন্যান্য পরিকাঠামোর অনেকটাই উন্নতি ঘটিয়ে ভারত সেই পরিস্থিতি বদলে দিল। কারাকোরাম পাস পর্যন্ত পৌছানোর জন্য শেষ ১৭-১৮ কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে যাওয়ার আগেই তাই একটা শেষ চেষ্টা করতে নেমেছে চীন। বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
কাজ কিন্তু বন্ধ করেনি ভারত। সীমান্তে উত্তাপ অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে। দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের বাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে। কিন্তু যে কাজ চলছিল, বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন তা চালিয়ে যাচ্ছে বলেই জানা যাচ্ছে।
ডোকলাম সঙ্ঘাতের সময়ে ভারতীয় সেনার ইস্টার্নকমান্ড-র প্রধান ছিলেন যিনি, সেই এলটি জেনারেল(অবসরপ্রাপ্ত)অভয় কৃষ্ণ -র কথায় "চীনকে মাঝেমধ্যে একটা রেড লাইন দেখিয়ে দেওয়ার দরকার হয়। লাদাখে আমাদের বাহিনী সেটাই করছে। ডোকলামেও চীন বাড়াবাড়ি করছিল। আমরা রেড লাইন টেনে দিয়েছিলাম ওদের সামনে। চীন বুঝে গিয়েছিল, আর এগোলে ভারত কিছু একটা করবে। লাদাখেও ঠিক সেই বার্তাটাই চীনকে দেওয়া হচ্ছে।"
সংগৃহীত
Via WhatsApp, edited by me.
Please see other posts in this blog page by clicking "Home" or from "My Favorite Posts" / "Popular Posts" / "Archives" sections, and if any remarks please feel free to post. Thanks & Vande Mataram!! Saroop Chattopadhyay.
ঐতিহাসিক গিরিপথের ওপারেই ইয়ারকন্দ, কাশগড়, খোটান, শাহিদুল্লার মতো একের পর এক ঐতিহাসিক জনপদ। সুবিশাল শিনচিয়াং প্রদেশকে সুরক্ষিত রাখতে এই জনপদগুলোর প্রত্যেকটা চীনের জন্য সাময়িকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
চওড়া এবং মসৃণ রাস্তা বানিয়ে ভারতীয় বাহিনী হু হু করে পৌঁছে যাবে সেই এলাকার দরজা পর্যন্ত, তা কি চীনের পক্ষে চুপচাপ মেনে নেওয়া সম্ভব! অতএব আবার পুরানো কৌশল। সীমান্ত উত্তপ্ত করে ভারতের কাজ আটকে দেওয়া। কিন্তু সে কৌশলে আর কাজ হচ্ছে না এবার। লাদাখ থেকে অন্তত তেমন খবরই আসছে।
মে মাসের শুরুর দিক থেকেই অশান্তি শুরু হয়েছিলো। প্রথমে লাদাখের প্যাংগং লেকের কাছে, তার পর উত্তর সিকিমের নাথুলা-তে। ১০ মে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম খবর পায় যে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর অন্তত দু’টি এলাকায় মারামারি হাতাহাতি হয়েছে ভারতীয় ও চীনা বাহিনীর মধ্যে।
ধস্তাধস্তি, পাথর ছোঁড়াছুঁড়ি, লাঠালাঠি এইসব। দু'পক্ষেই জখম হওয়ার খবর এসেছিল। তবে চীনা বাহিনীর অন্তত ১০০ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন উত্তর সিকিমের ওই সংঘর্ষের পরে, দাবি ভারতীয় সেনা সূত্রের।
১৯৬৭ সালের পর থেকে ভারত - চীন সীমান্তে গোলাগুলি চলার খবর প্রায় নেই বললেই চলে। সীমান্তে কাঁটাতার লাগাচ্ছিল ভারতীয় বাহিনী সেবার। বাধা দেয় চীন। ভারত বাধা মানেনি। রাইফেল থেকে গুলি চালায় চীনা বাহিনী। ভারতীয় সেনা লাইট মেশিন গান খুলে দেয়। চীন গুলি চালাতে শুরু করে হেভি মেশিন গান দিয়ে। ভারতীয় বাহিনী আর্টিলারি গান থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে।
সে বারও দু’তরফেই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। আর সে বারের পর থেকে সীমান্তে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহার করার বিষয়ে দু'পক্ষেই অনেক বেশি সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। তাই এলএসি বরাবর ভারত ও চীনের বাহিনীর মধ্যে যত সংঘাতের খবর আসে, সবই হাতাহাতি ও পাথর ছোড়াছুড়িতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। এবারও তাতেই ইতি পড়তে পারত উত্তেজনায়। কিন্তু তা হলনা, উত্তেজনা আরও গড়িয়ে গেল।
কারণ চীনের টেনশন এবার অনেক বেশি। পরিস্থিতি ঠিক কেমন এখন লাদাখে??
নয়াদিল্লি এখনও সরকারি ভাবে কিছু জানায়নি। কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এবং সেনা সূত্রে জানা যাচ্ছে, দু’পক্ষই বড় সংখ্যায় বাহিনী পাঠিয়েছে এলএসি-তে।
বড় সংখ্যা বলতে কেমন? দু’তরফেই অন্তত গোটা একটা করে ব্রিগেড,অর্থাৎ প্রায় হাজার তিনেক করে মোতায়েন দু'পাশেই। খবর তেমনই। গলওয়ান উপত্যকাই সবচেয়ে উত্তপ্ত বলে খবর আসছে। সংঘর্ষ শুরু হয়নি। কিন্তু চীনা বাহিনী ওই অঞ্চলে একতরফাভাবে এগিয়েছে এবং শ’খানেক তাঁবু ফেলেছে বলে খবর।
পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ পর্যায়ের সামরিক কর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। তারপর থেকে ভারতও দ্রুত বিপুল বাহিনী পাঠাতে শুরু করেছে গলওয়ান উপত্যকায়।
চীনা বাহিনীর প্রায় মুখোমুখি অবস্থানে তাদের চেয়েও বেশি সংখ্যক সেনা ভারত ইতিমধ্যেই মোতায়েন করে দিয়েছে।
গলওয়ানে আচমকা গজিয়ে উঠা চীনা শিবিরকে ভারত ইতিমধ্যেই তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে বলেও খবর।
তবে উত্তাপ শুধুমাত্র গলওয়ান উপত্যকায় সীমাবদ্ধ নয় বলেও ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ দাবি। প্যাংগং লেকের উত্তরে হট স্প্রিং এলাকায় এবং ডেমচকেও পরিস্থিতি তপ্ত বলে তারাও জানিয়েছেন। সর্বত্রই বাহিনী হাজির হয়েছে দু’তরফ থেকে।
২০১৭ সালে ভুটান চীন সীমান্তের ডোকলামেও কিন্তু পরিস্থিতি এরকম হয়েছিল। ভুটানের সাথেও সীমান্ত নিয়ে বিবাদ রয়েছে চীনের। একতরফাভাবে বিতর্কিত এলাকার মধ্যে দিয়ে রাস্তা তৈরির চেষ্টা করছিল চীন। ভুটানের পক্ষে বাধা দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই বাহিনী পাঠিয়ে দিয়েছিল ভারত।
৭৩ দিন পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল দুই বাহিনী। এবারের সংঘাত ততটাও দীর্ঘায়িত হইনি। তবে এবারে অনেক বড়ো এলাকা জুড়ে উত্তেজনাটা তৈরি হয়েছে। এবার বাহিনীর আকারটাও ডোকলামের তুলনায় অনেক বড়।
কর্নেল সৌমিত্র রায়ের কথায় "আকসাই চীনের সঙ্গে লাদাখের যে সীমানা, সেই সীমানা বরাবর লম্বা রাস্তা বানিয়েছে ভারত। লেহ্ থেকে রাস্তাটা শুরু হয়। কিছুটা দক্ষিণ- পূর্ব গিয়ে দারবুক থেকে বাঁক নেয় এলএসি -র দিকে অর্থাৎ পূর্ব দিকে। তার পর এলএসি র গা ঘেঁষে একটানা ছুটতে থাকে উত্তর দিকে। শিয়ক হয়ে দৌলত বেগ অলদি গিয়ে রাস্তাটা থামে।
ওই রাস্তাটাকেই চীন ভয় পাচ্ছে।
কেন ভয় পাচ্ছে?
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্তার ব্যাখ্যা "সীমান্তে ভারত ভালো রাস্তাঘাট এবং ভালো পরিকাঠামো বানাক, এটা চীন কখনও চায়না। সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারত উন্নয়নের কাজ করুক, এটাও চীন চায়না। কারণ সীমান্তে উন্নত পরিকাঠামো থাকলে ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে ওইসব এলাকায় মসৃণ ভাবে যাতায়াত এবং নজরদারি চালানো সম্ভব।"
নিজের সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী যাতায়াত করুক বা নজরদারি চালাক, তাতে চীনের বলার কী থাকতে পারে?
কর্ণেল রায় বলেছেন "আইনত চীনের কিছুই বলার নেই। কিন্তু আইন ভেঙেই বার বার চীন নাক গলাত। ভারতও তা মেনে নিত। এক সময় চীন আপত্তি করলেই ভারত কাজ থামিয়ে দিত। তাই নাক গলানোকে অভ্যাসে পরিণত করেছিল চীন।
কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে চীনের আপত্তি উড়িয়েই কাজ চালাতে শুরু করে ভারত। পূর্বে অরুণাচল থেকে উওরে লাদাখ পর্যন্ত প্রায় সর্বত্রই বড় বড় রাস্তা, সেতু, বিমানঘাঁটি এবং সামরিক পরিকাঠামো ভারত তৈরি করেছে এই সময়টায়। চীন সেসব আটকে রাখতে পারেনি। বরং ডোকলামে চীন যে রাস্তা তৈরি করেছিল, সেটাকেই আটকে দিয়েছিল ভারত।
পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে, লাদাখের যে কোনও অংশ থেকে তো বটেই, জম্মু কাশ্মীর এবং হিমাচলপ্রদেশ থেকেও যখন তখন হু হু করে পৌছে যাওয়া যাবে আকসাই চীনের সীমানায়। আরও একটু রাস্তা তৈরি হলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে আরও উওরে একেবারে কারাকোরাম পাসের বেস পর্যন্ত। সেটা চীনের পক্ষে খুব অস্বস্তিকর।"
কারাকোরাম পাসের বেস পর্যন্ত ভারত রাস্তা বানিয়ে ফেললে তা চীনের জন্য অস্বস্তিকর কেন? ??
লাদাখে যে সেনা কর্মকর্তারা কাজ করে এসেছেন, তাঁরা বলছেন, কারাকোরাম পাস কৌশলগত বা সামরিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিয়াচেনের উত্তর পূর্ব কোনায় ৫ হাজার ৫৪০ মিটার উচ্চতায় কারাকোরাম পাসের অবস্থান।
প্রগৈতিহাসিক যুগ থেকে ওই গিরিপথ ব্যাবহৃত হয়ে আসছে লাদাখের লেহ্ থেকে তারিম উপত্যকার ইয়ারকন্দের মধ্যে যাতায়াতের জন্য। তারিম উপত্যকা তথা ইয়ারকন্দ এখন চীনের শাসনাধীন। আর লেহ্ তথা লাদাখ ভারতের অংশ।
তাই আগের সেই অবাধ যাতায়াত বহু যুগ ধরেই বন্ধ। কিন্তু সীমান্তে যদি কখনও পরিস্থিতির অবনতি, তা হলে ওই গিরিপথ ব্যাবহার করে হানাদারির চেষ্টা চালাতে পারে দু'পক্ষই।
কারাকোরাম পাসের উওরে অর্থাৎ চীনা এলাকায় রাস্তা ঘাট এবং পরিকাঠামো অনেক দিন আগেই উন্নত করেদিয়েছে চীন। কিন্তু পাসের দক্ষিণে ভারতের পরিকাঠামো এতদিন অনুন্নতই ছিল। ফলে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ভারত চাইলেই কারাকোরামের গিরিপথ দিয়ে হানা দিতে পারবে না, কিন্তু চীন চাইলেই ওই গিরিপথ দিয়ে দক্ষিণে চলে আসতে পারবে- এই ভাবনা স্বস্তি দিত বেজিংকে।
ভারতের নতুন রাস্তা, বেজিঙের সেই স্বস্তি গায়েব করে দিয়েছে বলে ভারতীয় সমর বিশারদদের মত।
দারবুক থেকে দৌলত বেগ অলদি পর্যন্ত ২৫৫ কিলোমিটার রাস্তা তৈরির কাজ শেষ, জানাচ্ছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। ওই রাস্তায় একাধিক সেতু বানাতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় যে সেতু, সেটা তৈরি হয়েছে শিয়ক নদীর উপরে। ২০১৯ এর অক্টোবরে সেই সেতুর উদ্বোধন বেশ ঢাকঢোল পিটিয়েই করেছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ।
দৌলত বেগ অলদিতে ভারত বিমানঘাঁটিও বানিয়ে ফেলেছে আগেই। এবার দৌলত বেগ অলদি থেকে কারাকোরাম পাস পর্যন্ত ১৭-১৮ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করে ফেললেই চীনের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলার তোড়জোড় সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। অনেকরকম ভাবেই এই কাজকে আটকানোর চেষ্টা করেছিল চীন। পারেনি। এবার তাই মরিয়া হয়ে কামড় দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে।
জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) বেদপ্রকাশ মালিক থেকে জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) জে জে সিংহ, প্রত্যেকেই এইরকম মনে করছেন।
কার্গিল যুদ্ধের সময়ে ভারতের সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল মালিক। তিনি বলছেন, ভূপ্রাকৃতিক কারণে এলএসি-র এপাশে অর্থাৎ লাদাখে সেনা পাঠানো ভারতের পক্ষে যতটা সহজ, এলএসি-র ওপাশে অর্থাৎ তিব্বতের দিকে ততটা সহজ নয়।
চীন ওই সব অঞ্চলে সড়ক পরিকাঠামো বাড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিপুল সংখ্যক সেনা নিয়ে এসে এলএসি বরাবর ঘাঁটি গেড়ে থাকা চীনের পক্ষে অপেক্ষাকৃত কঠিন বলে তার মত। ভারতের ক্ষেত্রে সেই অসুবিধা নেই।
ওই সব অঞ্চলে বড় বাহিনী মোতায়েন রাখা ভারতের পক্ষে খুব একটা কঠিন কোনকালেই ছিলনা, সমস্যা ছিল শুধু যাতায়াতের, সেটাও ভারত ক্রমশ মিটিয়ে ফেলেছে, সুতারাং চাপে পড়া চীনের পক্ষে স্বাভাবিক - ব্যাখ্যা জেনারেল মালিকের।
ভূপ্রাকৃতিক দিক থেকে ভারতের জন্য দুর্বল বিন্দু ছিল শুধুমাত্র কারাকোরাম পাস। আর চীনের জন্য সুবিধাজনক বিন্দুও ছিল ওটাই। কারণ কারাকোরাম পাসের ঠিক দক্ষিণে লাদাখের যে অংশ, সে এলাকা এতই জনবিরল এবং মরুভূমি সদৃশ যে, বাহিনী মোতায়েন রাখার পক্ষে ওই এলাকা মোটেও অনুকূল ছিল না।
কিন্তু কারাকোরাম পাসের উওরে তারিম অববাহিকা বা কারকাশ উপত্যকার ভূপ্রকৃতি এবং আবহাওয়া অনেকটাই সহনীয়। ওই অঞ্চলে বাহিনী রাখা বা ওই অঞ্চল দিয়ে তাড়াতাড়ি কারাকোরাম পাস পেরিয়ে আসা অপেক্ষাকৃতভাবে সহজ। নিজেদের জন্য এই সুবিধাজনক পরিস্থিতিটা কোনও ভাবে বদলে যাক, তা চীন চাইনি।
কিন্তু দৌলত বেগ অলদি পর্যন্ত রাস্তা বানিয়ে, যোগাযোগ ও অন্যান্য পরিকাঠামোর অনেকটাই উন্নতি ঘটিয়ে ভারত সেই পরিস্থিতি বদলে দিল। কারাকোরাম পাস পর্যন্ত পৌছানোর জন্য শেষ ১৭-১৮ কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে যাওয়ার আগেই তাই একটা শেষ চেষ্টা করতে নেমেছে চীন। বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
কাজ কিন্তু বন্ধ করেনি ভারত। সীমান্তে উত্তাপ অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে। দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের বাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে। কিন্তু যে কাজ চলছিল, বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন তা চালিয়ে যাচ্ছে বলেই জানা যাচ্ছে।
ডোকলাম সঙ্ঘাতের সময়ে ভারতীয় সেনার ইস্টার্নকমান্ড-র প্রধান ছিলেন যিনি, সেই এলটি জেনারেল(অবসরপ্রাপ্ত)অভয় কৃষ্ণ -র কথায় "চীনকে মাঝেমধ্যে একটা রেড লাইন দেখিয়ে দেওয়ার দরকার হয়। লাদাখে আমাদের বাহিনী সেটাই করছে। ডোকলামেও চীন বাড়াবাড়ি করছিল। আমরা রেড লাইন টেনে দিয়েছিলাম ওদের সামনে। চীন বুঝে গিয়েছিল, আর এগোলে ভারত কিছু একটা করবে। লাদাখেও ঠিক সেই বার্তাটাই চীনকে দেওয়া হচ্ছে।"
সংগৃহীত
Via WhatsApp, edited by me.
Please see other posts in this blog page by clicking "Home" or from "My Favorite Posts" / "Popular Posts" / "Archives" sections, and if any remarks please feel free to post. Thanks & Vande Mataram!! Saroop Chattopadhyay.
No comments:
Post a Comment